বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ৮২ শতাংশ শিশুকে দুই বছর বয়সের আগেই টিকা দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার হার ৯৯ শতাংশ। এই অর্জনের মূলে রয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই। ইপিআই কর্মসূচি প্রবর্তনের আগে বাংলাদেশে ছয়টি প্রধান প্রাণঘাতী রোগে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ শিশু মারা যেত। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যু হত ডায়রিয়াজনিত রোগে, এক-তৃতীয়াংশ হত ছয়টি প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ হত অন্যান্য রোগের কারণে। এসব শিশুদের মধ্যে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি।
শিশুদের যে ছয়টি রোগের টিকা দেওয়া হয় তার তালিকায় রয়েছে: যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, গুটি বসন্ত, পোলিও এবং হাম। বর্তমানে দেশে শূন্য থেকে দুই বছর বয়সী সকল শিশুকে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর-এর মতে, ২০০১ সাল থেকে এই দশটি টিকার বিস্তার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালে, ১২ মাস বয়সী শিশুদের ৫২ শতাংশকে টিকা দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালে এসে এই হার বেড়ে ৮৩.৯ শতাংশ হয়েছে (উৎস- কভারেজ ইভালুয়েশন সার্ভে ২০১৯)।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ফলে পোলিওর মতো রোগের ঘটনা এখন আর পাওয়া যায় না। ২০১৪ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক সার্টিফিকেশন কমিটি কর্তৃক বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত দেশ ঘোষণা করা হয়। ইপিআই প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র হাসপাতালগুলিতে পরিচালিত হত কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আউটরিচ কেন্দ্রগুলিতেও এটি প্রসারিত হয়েছে। এর মাধ্যমে টিকার বিস্তার বৃদ্ধিতে ইপিআই-এর প্রধান অসুবিধার সমাধান করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতরের নীতিনির্ধারকগণ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নকে তিনটি ওয়ার্ডে ও আটটি সাব-ব্লকে বিভক্ত করেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিয়নে ২৪টি সাব-ব্লক রয়েছে। প্রতিটি ব্লকে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে একটি অস্থায়ী টিকা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি মূলত “আউটরিচ সেন্টার” নামে পরিচিত। এছাড়া উপজেলা হাসপাতাল, জেলা ও সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে টিকাদান কেন্দ্র। এগুলো সবই টিকাদান কর্মসূচিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করছে। এই সাফল্যের পেছনে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা, স্বেচ্ছাসেবকদের মাঠপর্যায়ের প্রচেষ্টা এবং দিনে দিনে ইপিআই এর পরিধি সম্প্রসারণের পাশাপাশি আরও অনেক বিদেশী সংস্থার অবদান রয়েছে।
টিকা নিয়ে জনগণের ভুল ধারণা দূর করতে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণেরও চেষ্টা থেমে নেই। বর্ধিত টিকাদান কভারেজ, গণটিকা প্রচারাভিযান এবং নতুন টিকা প্রবর্তনের ফলে টিকা গ্রহণের হার বেড়েছে। এছাড়াও, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তথ্যের আদান-প্রদানের ফলে ভ্যাকসিন সুরক্ষা সম্পর্কে জনগণের মধে সচেতনতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা টিকার সুরক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ নিয়মিত টিকা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পদকে ভূষিত করে। এর আগে ২০০৯ ও ২০১২ সালে ‘গ্যাভি বেস্ট পারফরম্যান্স’ পুরস্কার জিতেছিল বাংলাদেশ। এত কিছুর পরেও, কিছু শিশু এখনও মৌলিক টিকার সম্পূর্ণ কোর্স পায় না এবং আরও অনেকে নতুন টিকা থেকে বঞ্চিত হয়, এর ফলে তারা প্রতি বছর ভ্যাকসিন-প্রতিরোধযোগ্য রোগের ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাবের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দেশ ও ভৌগলিক অঞ্চলভেদে টিকাদান বিস্তারে ঘাটতি এবং অসমতা বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান।
২০১৪ এবং ২০১৭-২০১৮ সালে ১২-২৩ মাস বয়সী শিশুদের উপর পরিচালিত জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে দেখা যায় যে টিকা বিস্তারের পরিস্থিতি বসবাসের স্থান, শ্রেণী বিভাজন, পরিবারের সম্পদ বন্টন, জন্মের ক্রম, মায়ের শিক্ষা, পিতার শিক্ষা, মায়েদের পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের প্রাপ্তি, চারটি এএনসি ভিজিট, প্রসবের স্থান এবং দুই মাসের মধ্যে প্রসবোত্তর স্বাস্থ্য পরিচর্যা পরিদর্শন – এসব বিভিন্ন কারণ দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল। তাই সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর পূর্ণ বিস্তৃতি অর্জনে এসব বিষয়ের প্রতি নজর দেয়াও অতীব জরুরী।