আমরা যখন আগস্টের এক পড়ন্ত দুপুরে এই ইন্টারভিউটি নিতে যাই, তখন মিনারা বেগম তার ৪ মাস বয়সী ছেলে হোসেনকে কোলে নিয়ে বিওপিভি, পিসিভি ও পেন্টাভ্যালেন্টের ১ম ডোজের টিকা দেওয়াতে এসেছিলেন। নার্স সিলভি আক্তারের সাথে দেখা করতে এবং প্রয়োজনীয় টিকার ডোজ গ্রহণ করতে তাদের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে। বাংলাদেশে যেখানে রোগীদের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়, সেখানে এরকম দ্রুত সার্ভিস একটি বড় ব্যাপার। তবে এখানেই ব্যতিক্রম নয়, রাজধানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় অবস্থিত আলো ক্লিনিক– এ এরকম দ্রুত পরিষেবা একটি নিয়মিত ঘটনা।
ক্লিনিকটি তার নামের স্বার্থকতা প্রমাণ করছে; কারণ এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি কড়াইল বস্তি এবং আশেপাশের এলাকার ১৪০,০০০ বাসিন্দার জন্য আশার আলো হিসাবেই কাজ করছে। এখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় রোগীদের মানসম্মত সেবা প্রদান করা হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে ক্লিনিকটি শুধুমাত্র বস্তিবাসীদের সেবা দেওয়ার জন্য লক্ষ্য করা হয়েছিল, তবে শীঘ্রই এটি আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এটি বিনামূল্যে রুটিন ভ্যাকসিনেশন পরিষেবা সরবরাহ করে।
নার্স সিলভি বলেন, ‘আমরা যখন প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন এলাকার মানুষ শিশুদের ইপিআই টিকার ব্যাপারে তেমন সচেতন ছিল না। তারা জানলেও তারা জানত না যে আমরা বিনামূল্যে ইপিআই’র টিকা দিচ্ছি। তখন আমরা প্রতিদিন ১০-১৫ জন শিশুকে সেবা দিতাম। “কিন্তু আমাদের পরিষেবার খবর প্রতিটি বাড়িতে মুখে মুখে পৌঁছানোর সাথে সাথে আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৫০ টি শিশু পেতে শুরু করি। এমনকি আশেপাশের স্বচ্ছল এলাকার লোকজনও তাদের সন্তানদের নিয়ে আমাদের ক্লিনিকে আসতে শুরু করে।
আলো ক্লিনিক ২০২২ সালের আগস্ট থেকে শুরু হওয়া নগরবাসীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি দুই বছরের পাইলট প্রকল্প। সুইডিশ দাতা সংস্থা ‘সিডা’র অর্থায়নে প্রকল্পটির কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে ইউনিসেফ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরবান হেলথ কেয়ার স্কিম/বিভাগের আওতায় আলো ক্লিনিকের এই মডেল পদ্ধতি প্রয়োগের পরিকল্পনা চলছে। আলো ক্লিনিক শুধু কড়াইল বস্তিতেই নয়, ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য এলাকায়ও আলো ক্লিনিক রয়েছে।
নার্স সিলভি বলেন, “শুরুতে আমরা মায়েদের কাছ থেকে কিছু অভিযোগ বা উদ্বেগ পেতাম যে টিকা দেওয়ার পরে তাদের বাচ্চাদের জ্বর হচ্ছে এবং তাদের স্বামীরা তাদেরকে এজন্য দোষারোপ করছেন। “তারপর, আমরা তাদের স্বামীদের ডেকেছি এবং টিকা দেওয়ার সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাদের সচেতন করেছি, তাই তারা তাদের উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেয়েছি,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
নার্স সিলভি বলেন, ‘আমি মায়েদের কাছ থেকে অসংখ্য অনুরোধ পেয়েছি যে, যদি সন্ধ্যায় ইপিআই টিকা দেওয়ার সেশন থাকে তবে তাদের পক্ষে তাদের বাচ্চাদের টিকা দেওয়া সহজ হবে। “একবার, আমি এমনকি ১০ বছর বয়সী একটি মেয়েকে তার ছয় মাসের ভাইকে কোলে নিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য আমাদের ক্লিনিকে আসতে দেখেছিলাম, কারণ তাদের মা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি আশাবাদী, ইপিআই টিকার সন্ধ্যার সেশন শুরু হলে আমরা আরও ইতিবাচক সাড়া পাব।”
আলো ক্লিনিকের প্রযুক্তিগত দক্ষতা তাদের দ্বৈত ট্র্যাকিং সিস্টেম দ্বারা প্রমাণিত – এর মধ্যে একটি হল ইপিআই দ্বারা প্রদত্ত টিকাদানের প্রচলিত রেজিস্টার বই এবং অপরটি হচ্ছে আলো ক্লিনিকের নিজস্ব ক্লাউড-ভিত্তিক ডিজিটাল নিবন্ধন ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিটি টিকাদানের হার, সময়সূচী এবং এমনকি সক্রিয় আউটরিচের সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে, যাতে কোন শিশু একটিও গুরুত্বপূর্ণ ডোজ মিস না করে। এটি তাদের ভ্যাকসিনের চাহিদা গণনা করতেও সহায়তা করে, যাতে তারা আরও দক্ষতার সাথে সিটি কর্পোরেশনকে ভ্যাকসিনের চাহিদা ফরমায়েশ করতে পারে।
আলো ক্লিনিকের কড়াইল শাখায় দুজন পুরুষ ও দুইজন নারী এমবিবিএস চিকিৎসক রয়েছেন। এখানে প্রতি শিফটে একজন মহিলা ও একজন পুরুষ চিকিৎসক, দু’জন প্যারামেডিক এবং একজন নার্সসহ চৌদ্দ জন কর্মী কাজ করেন। দেশে ক্রমবর্ধমান শহুরে জনসংখ্যার সাথে সাথে অসংক্রামক রোগসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। কিন্তু শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অভাবে তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার চাপ বাড়ছে। সুতরাং, আমাদের সুপারিশ হচ্ছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে শহুরে স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করতে এবং ইপিআই টিকাদানের হার বাড়ানোর জন্য আলো ক্লিনিক-এর মডেল গ্রহণ করা উচিত।