জনস্বাস্থ্য সেবার জগৎে খুব কম উদ্যোগ ই বাংলাদেশের ‘সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি’ (ইপিআই) এর সফলতার সমকক্ষ হতে পারবে। অসংখ্য জীবনরক্ষাকারী সুদূরপ্রসারী এই টিকাদান কর্মসূচি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট সাফল্য। এই সফলতার মাঝে একটি উল্লেখযোগ্য বাঁধা: ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম এলাকায় “শূন্য-ডোজ” এবং জরুরী টিকা না পাওয়া শিশু এখনও বিদ্যমান। 

এই সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করার পর ইপিআই এইসব ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও কমিউনিটির কাছে পৌঁছানোর বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে। টিকাদান কর্মসূচির কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইপিআই এর কার্যক্রমে কিছু উদ্ভাবনী প্রযুক্তি সংযুক্ত করার প্রস্তাবনা প্রদান করে। বিশেষ করে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে। 

জিআইএস আসলে কি? আর কিভাবেই বা এটি বাংলাদেশের ইপিআই কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করবে? সহজ ভাষায় বলা যায় যে, জিআইএস এমন একটি মাধ্যম যা টিকা দেওয়ার এলাকার জিওস্পেশিয়াল বা স্থানভিত্তিক বিস্তারিত তথ্যের ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার স্থানের সমবন্টন, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং অন্যান্য নির্ধারক চিহ্নিতকরণে সহায়তা করে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রভাবক যেমন, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, দুর্গম এলাকা, বস্তি এলাকা সহ টিকা প্রদান কেন্দ্র থেকে গ্রহণকারীর এলাকার দুরত্ব ও জিআইএস বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ জিআইএস প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইপিআই প্রোগ্রামের পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ এবং নীতি- নির্ধারণী কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। 

বাংলাদেশে ইপিআই প্রোগ্রামে জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ছিলো একটি যৌথ প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ শাখা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান সদরদপ্তরের জিআইএস টিম এর সাথে বাংলাদেশে ইপিআই এবং স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের এমআইএস যৌথভাবে কাজ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আইভিডি নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য বিভাগের সদস্যদেরকে ‘আর্কজিআইএস’ এর উপরে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কর্মরত ব্যক্তিগণ এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেকোন জরুরী স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পারদর্শী হয়ে উঠবে। 

জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করার এই উদ্যোগে, ইপিআই প্রোগ্রাম উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সহায়তায় বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা এবং ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনে ইতিমধ্যেই এর সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরকে জিআইএস ভিত্তিক ম্যাপিং এবং আর্কজিআইএস ব্যবহার করে বিশদ পরিকল্পনা করার ব্যাপারে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। একটি কর্মশালার মাধ্যমে ডিজিটাল মাইক্রোপ্লানিং ভিত্তিক কর্মএলাকার ম্যাপ তৈরি করা হয়। এছাড়াও, একটি জাতীয় পর্যায়ের কর্মশালার মাধ্যমে এইসব পাইলট এলাকার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরা হয়। 

সামনের দিনগুলোতে কাজের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে ইপিআই প্রোগ্রামে জিআইএস নিয়ে বেশ সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, কমপক্ষে আটটি জেলা এবং চারটি সিটি কর্পোরেশনকে জিআইএস-ভিত্তিক ম্যাপিং এবং মাইক্রোপ্ল্যানিং এর অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ভৌগলিক অবস্থানের বাঁধাকে অতিক্রম করে সকল শিশুর জন্য  তার প্রাপ্য জীবন রক্ষাকারী টিকা নিশ্চিত করাই এই উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি। 

পরিশেষে, বাংলাদেশে ইপিআই প্রোগ্রামে জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার এর মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। জনস্বাস্থ্য খাতের সমস্যা মোকাবেলায় প্রযুক্তি এবং পারস্পারিক সহযোগিতার শক্তির প্রমাণ দেয় এই উদ্যোগ এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি মনে করি এই গল্প বিশ্ববাসীর জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই সাইটটি স্প্যাম কমাতে Akismet ব্যবহার করে। আপনার মন্তব্য কীভাবে প্রক্রিয়া করা হয় তা জানুন