বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলের শিশুদের তুলনায় শহরাঞ্চলের শিশুরা সব রুটিন ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রবণতা তুলনামূলক কম। যাইহোক, জেলা পর্যায়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে বাস্তবতা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং জটিল। টিকার বিস্তারের উপাত্ত এরকমটাই নির্দেশ করে। আর এই পার্থক্যটি বুঝতে আরও গভীর ও বহুমাত্রিক গবেষণার প্রয়োজন।

বাংলাদেশে শহুরে-গ্রামীণ টিকাদানের বৈষম্য নতুন কিছু নয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী (ইপিআই) এর “কভারেজ মূল্যায়ন সমীক্ষা বা কভারেজ ইভালুয়েশন সার্ভে (সিইএস)” 1 থেকে টিকার বিস্তারে শহুরে এবং গ্রামীণ হারের মধ্যে একটি নিয়মিত ব্যবধান লক্ষ্য অরা যায়। সিইএস-২০১৬ অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকায় ৮৩.৫% কভারেজের তুলনায় শহুরে টিকাদান কভারেজ ছিল ৭৭.১%। সিইএস-২০১৯ সালের তথ্যমতে শহুরে এবং গ্রামীণ টিকাদান কভারেজের এই হার ছিল যথাক্রমে ৭৯.২% এবং ৮৫%। এমনকি ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর যৌথ জাতীয়/আন্তর্জাতিক ইপিআই এবং ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগ নজরদারি পর্যালোচনা 2 রিপোর্টেও বাংলাদেশে শহুরে টিকাদান একটি ফোকাস পয়েন্ট হয়ে উঠেছে।

পর্যালোচনাটি শহুরে টিকাদানের চ্যালেঞ্জগুলির উপর জোর দেয়, ইঙ্গিত করে যে ২০১৬ সালে ১১টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে মাত্র ৪টি সিটি কর্পোরেশনে প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে ৪টি শিশুকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ঢাকা শহরে প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে ২টি শিশু সম্পূর্ণ কভারেজের বাইরে অবস্থান করে। শহরাঞ্চলে টিকাদান পরিষেবার এই বৈষম্যগুলোর পিছনে ইপিআই-এর অসামাঞ্জস্য বিধানগুলোও অন্যতম কারণ। যেহেতু বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যা ২০১৬ সালে ৫৩ মিলিয়ন থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৮০ মিলিয়নে উন্নীত হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে, তাই এই চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুত মোকাবেলা করা প্রয়োজন।

সরকার সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন, যেমন: প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর অভাব, স্থানীয় সরকার, এনজিও এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে কাঠামোগত জটিলতা, যোগাযোগের অভাব এবং সম্পদের সীমিত সংস্থান। সিটি কর্পোরেশনগুলির মধ্যে টিকাদান বিস্তারের পার্থক্য থেকে বোঝা যায় যে উন্নতিগুলো অর্জন করা সম্ভব। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক টিকাদানের জন্য নিবেদিত কর্মীদের নিয়োগের ফলে কভারেজের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে বর্তমানে সম্পূর্ণ কভারেজের হার ৯২.৪% এবং এমনকি পেন্টাভ্যালেন্ট (DTPcv) ভ্যাকসিনের সমস্ত ডোজগুলির জন্য কভারেজের হার ৯৮.৪%।

ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফপিএবি)-এর একজন জেলা টিকাদান সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদ জনি আশা করেন যে তার প্রতিষ্ঠান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের উদাহরণ অনুসরণ করবে। সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে আরও মেডিকেল অফিসার থাকলে সরকারের সাথে যোগাযোগ উন্নত করতে এবং বিভিন্ন এনজিও টিকাদান পরিষেবা এবং বেসরকারি ক্লিনিকগুলির মধ্যে আরও ভাল সমন্বয় ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। তার মাঠকর্মীরা নিয়মিত অভিযোগ করেন যে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলি তাদের ক্লিনিকে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের টিকা কার্ড সম্পর্কে কোন নির্দেশনা প্রদান করে না, বা টিকাদানকারীরা অন্যান্য টিকাদান কেন্দ্রে শিশুদের টিকাদানের তথ্য আদান-প্রদান করতে অস্বীকার করে। উন্নত সমন্বয় এবং টিকাদান প্রশিক্ষণ অবশ্যই সেবা প্রদানকারীদের ঢাকা দক্ষিণের দরিদ্র শহরবাসীদের মধ্যে কভারেজের হার বাড়াতে সহায়তা করবে, যা রাজশাহী শহরের থেকে প্রায় দশ শতাংশ হারে পিছিয়ে রয়েছে।

সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলাগুলির টিকাদানের হারগুলি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলে দেখা যায় যে শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে কার্যক্ষমতার বড় পার্থক্য রয়েছে৷ সিইএস-২০১৯ অনুযায়ী সেরা পারফরম্যান্সকারী জেলা বরিশালের হারের তুলনায় রাজশাহীর কভারেজের হার আসলে কিছুটা বেশি। অপরদিকে কম কাভারেজের মধ্যে খুলনা জেলার হার সিলেট সিটি কর্পোরেশনের হারের প্রায় কাছাকাছি, উভয়ই ৬৫% পূর্ণ কভারেজের কম স্কোর করেছে। 

সংখ্যা কখনো ভুল তথ্য দেয় না, কিন্তু তারা মাঝে মাঝে একই কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের সন্নিবেশ ঘটায়। জাতীয় স্তরে ইমিউনাইজেশন কভারেজ ডেটা বিশ্লেষণ আর জেলা বা উপ-জেলা স্তরের ডেটা বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু উপলব্ধ হবে। খুলনা জেলা এবং সিলেট শহর উভয়েরই তাদের টিকাদান কর্মক্ষমতা উন্নত করতে হবে, কিন্তু তারা একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করতে পারে। যেমন: যারা এখনও পর্যন্ত নিয়মিত ভ্যাকসিনের এক ডোজ পাননি এবং যারা শুধুমাত্র গ্রহণ করেছেন তাদের সনাক্ত করা এবং তাদের কাছে পৌঁছানো এই ভ্যাকসিন কাভারেজের অংশ। 

ইমিউনাইজেশন ইক্যুইটি বা টিকাদানের সাম্যতা সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণা এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যারই ধারাবাহিকতায় গ্যাভি, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় একটি কান্ট্রি লার্নিং হাব প্রকল্প শুরু করেছে। দেশে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি-এর নেতৃত্বে সিইএস এবং অন্যান্য উৎস থেকে টিকাদান ডেটার একটি দ্রুত মূল্যায়ন প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে৷ এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে, গ্রামীণ এবং শহর উভয় ক্ষেত্রেই কভারেজের হার বৃদ্ধি করতে সক্ষম হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট জেলাগুলিকে কম কভারেজ রেট এবং উচ্চ সংখ্যক জিরো-ডোজ এবং কম টিকা দেওয়া শিশুদের সনাক্ত করতে সূক্ষ্ম কৌশলগুলি বেছে নেওয়া হবে। কারণ আমাদের লক্ষ্য এমন হওয়া উচিত যাতে টিকার সুযোগ থেকে কোনও শিশুই বঞ্চিত না হয়। 

 

তথ্যসূত্র

  1. বাংলাদেশ ইপিআই কভারেজ ইভালুয়েশন সার্ভে, টিকাদানের সম্প্রসারিত প্রোগ্রাম (২০১৬ এবং ২০১৯)। ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিস (DGHS)। 
  2. দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য 2 বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়। (২০১৯) টিকা এবং ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগ নজরদারি সম্পর্কিত যৌথ জাতীয়/আন্তর্জাতিক সম্প্রসারিত কর্মসূচি, বাংলাদেশ ২৮ জুলাই – ৬ আগস্ট ২০১৮
শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.