টিকাপ্রাপ্তি পৃথিবীর প্রতিটি শিশুর জন্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। বর্তমান দশকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাত প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছানো এবং সম্পূর্ণ টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত নিবেদিত। নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে ১৯৯০ সাল থেকে টিকাদানের বিস্তৃতি কমতে শুরু করে। এমনকি দরিদ্র দেশগুলিকে টিকা পেতে প্রায় সাত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, কারণ ধনী দেশগুলিকে প্রথমে টিকা দেয়া হচ্ছিল। নবজাতক শিশুদের কিছু প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে না এবং তারা হাম, পোলিও এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। “গ্যাভি, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স”, ‘যে সব শিশু ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং পারটুসিস (ডিটিপি) এর একটি ডোজও গ্রহণ করেনি তারা শূন্য-ডোজ শিশু’ বলে অভিহিত করেছে।
অনেক শিশু প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেয় কিন্তু সব টিকা পায় না। এই শিশুদেরকে বলা হয় “স্বল্প-টিকাপ্রাপ্ত”, কারণ তারা নিয়মিত টিকা কার্যক্রমের সম্পূর্ণ কোর্স পায়নি। “গ্যাভি” এই “স্বল্প-টিকাপ্রাপ্ত” শিশুদের সংজ্ঞায়িত করে ‘যারা ডিটিপির তৃতীয় ডোজ পায়নি’ [২]। এই শিশুদের সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত প্রজাতি হওয়ার কারণে, আমরা আমাদের শিশুদের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাহীনভাবে ছেড়ে দিতে পারি না এবং তা করা উচিত নয়।
এক্ষেত্রে একটি জরুরী প্রশ্ন আসে যে এই জিরো-ডোজ এবং কম টিকাপ্রাপ্ত শিশুরা কোথায় থাকে। এই শিশুরা সাধারণত “বঞ্চিত-গোষ্ঠী”-গুলোতে বসবাস করছে। একটি “বঞ্চিত-গোষ্ঠী”তে অবস্থিত পরিবারের পরিস্থিতি অন্যান্য সাধারণ পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। নাগরিক মৌলিক পরিষেবাগুলি এসকল গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল এবং সামাজিক অবস্থানও নাজুক হয়ে থাকে [3]। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইক্যুইটি ইন হেলথের ডিএইচএস/এমআইসিএস জরিপ তথ্য অনুসারে, এই সম্প্রদায়গুলিতে শিশু এবং মায়েদের মৃত্যুর হারও বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে, জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশ দুর্গম এলাকায় বাস করে, যেমন- শহুরে বস্তি, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ৩টি পার্বত্য জেলায়। এই অঞ্চলগুলিকে “বঞ্চিত-গোষ্ঠী” হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, কারণ সেখানে জীবনযাত্রার পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন এবং এই অঞ্চলগুলিতে সামাজিক পরিষেবাগুলিও বেশ অপ্রতুল। বেশিরভাগ বস্তি অকল্পনীয়ভাবে দূষিত জলাশয়ের পাশে গড়ে উঠে। অনেক সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে এই সম্প্রদায়ের শিশুদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। এই শিশুদের কাছে টিকার সেবা পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হল যখন তাদের নিকটতম টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় [৪]।
বস্তিতে বসবাসকারী লোকেরা দিনমজুর, গৃহস্থালি ও অফিস সহায়ক কর্মী এবং অন্যান্য শ্রমসাধ্য পেশায় কাজ করে থাকে। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের পক্ষে তাদের শিশুদের সময়মত টিকা দেওয়া বেশ কঠিন। তাই “বঞ্চিত-গোষ্ঠী”র শিশুদের পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য একটি সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনা প্রয়োজন [5]। তবে বিগত বছরগুলিতে বাংলাদেশ গণ টিকাদানে যে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নীতিনির্ধারক এবং সরকারের উচিত এই বঞ্চিত শিশুদের দিকে বিশেষ দৃষ্টিপাত করা। অতএব, এই সম্প্রদায়গুলিতে প্রবেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপায় বের করা প্রয়োজন। সরকার, এনজিও, উন্নয়ন অংশীদার – সকলের উচিত এই জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য বৃহৎ পরিসরে প্রচারণা চালানো, যাতে স্বাস্থ্যকর্মী, পরিষেবা প্রদানকারী এবং নীতিনির্ধারকরা এই বঞ্চিত ও স্বল্প-টিকাপ্রাপ্ত শিশুদেরকে টিকার আওতায় আনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন।
তথ্যসূত্র: